বাংলাদেশের সামগ্রিক ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিমা খাতের ভূমিকা থাকলেও এ খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় ঘাটতি রয়েছে। এতে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে এ খাতে ঝুঁকি বাড়ছে। আর্থিক খাতের এ ঝুঁকি নিরসনের ক্ষেত্রে বিমা খাতকে যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সাধারণ বিমা করপোরেশন ও জীবন বিমা করপোরেশনের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও কার্যকারিতা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করে সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিমা খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে বিভিন্ন প্রশাসনিক ও আইনি সংস্কার শুরু করেছে সরকার। সরকার মনে করে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের তদারকি ও নজরদারি আরো বাড়ানো প্রয়োজন। এ নজরদারি কার্যকরভাবে পালন এবং বিমা খাত তত্ত্বাবধানে সক্ষমতা অর্জন ও সামর্থ্য বাড়ানোর জন্য অধিকতর উপযোগী নীতি ও পদ্ধতি প্রবর্তন করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে বিমা খাতের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং প্রশিক্ষিত জনবল উন্নয়ন ও পেশাদারিত্ব বাড়িয়ে এ খাতে জনমানুষের আস্থা বাড়ানো প্রয়োজন। তাই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সাধারণ বিমা করপোরেশন ও জীবন বিমা করপোরেশনের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও কার্যকারিতা বাড়ানো জরুরি বলেও মনে করেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
এ লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশের বিমা খাত উন্নয়ন’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। মোট ৬৩২ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ১১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেয়া হবে। বাকি ৫১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা সহায়তা বাবদ পাওয়া যাবে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে। প্রকল্পটি সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতায় বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়ন করবে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে। স¤প্রতি প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি একনেকের অনুমোদন পেয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্পটি এ বছরের জানুয়ারিতে শুরু হয়েছে যা ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশের সব উপজেলায় অবস্থিত রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা করপোরেশনগুলো এ প্রকল্পের আওতায় আসবে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে আরো জানা গেছে, প্রকল্পটি প্রথমে কারিগরি সহায়তা প্রকল্প হিসেবে ‘বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এন্ড প্রাইভেট পেনশন মার্কেট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ শিরোনামে প্রণয়ন করা হয়। ২০১৬ সালের ২২ প্রকল্পের ওপর পরিকল্পনা কমিশনে বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (এসপিইসি) সভায় প্রকল্পটি টিপিপির পরিবর্তে ডিপিপি প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সূত্র জানায়, প্রকল্পটি যখন টিপিপি আকারে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়, তখন প্রকল্পটির মোট ৪টি কম্পোনেন্ট ছিল। এর প্রথমটি হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সামর্থ্য বৃদ্ধিকরণ ও বিমা একাডেমির আধুনিকায়ন। দ্বিতীয়ত- রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সাধারণ বিমা করপোরেশন ও জীবন বিমা করপোরেশনের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও কার্যকারিতা বাড়ানো। তৃতীয়ত- বেসরকারি পেনশন তহবিল গঠন ও তহবিল গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সমীক্ষা পরিচালনা এবং চতুর্থত- প্রকল্পের কার্যকর ও সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিটে উপযোগী কারিগরি পরিবেশ নির্মাণ করা।
পরবর্তী সময়ে এ প্রকল্পের বিষয়ে অর্থ বিভাগের মতামত ও পরামর্শ অনুযায়ী প্রকল্পের ৩ নম্বর কম্পোনেন্ট অর্থাৎ ‘বেসরকারি পেনশন তহবিল গঠন ও তহবিল গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সমীক্ষা পরিচালনা’ বাদ দেয়া হয়। সে অনুযায়ী বাকি ৩টি কম্পোনেন্টের সমন্বয়ে বিনিয়োগ প্রকল্প হিসেবে মোট ৬৩২ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় নিয়ে প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়ন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এরপর বিনিয়োগ প্রকল্পটির ওপর পরিকল্পনা কমিশনে গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। পিইসি সভার সিদ্ধান্তে আলোকে ডিপিপি পুনর্গঠন করে তা পুনরায় পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্র জানায়, বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইন্স্যুরেন্স করপোরেশনের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা শক্তিশালী করা, বাংলাদেশে ইন্স্যুরেন্স কাভারেজ বাড়ানো, বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এবং বিমা একাডেমির সক্ষমতা এবং কার্যকারিতা উন্নয়ন এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমা করপোরেশনগুলো আধুনিকায়ন, শক্তিশালীকরণ এবং এগুলোর কর্মদক্ষতা বাড়ানো এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য।
প্রকল্পের আওতায় বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সার্বিক অটোমেশনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইসিটি সুবিধা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি সংগ্রহ, বিমা একাডেমির প্রশিক্ষণ সুবিধা বাড়ানো ও আধুনিকায়ন, বিমা সেবা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো, বিমা খাতে ঝুঁকিভিত্তিক তত্ত্বাবধান পদ্ধতি প্রবর্তন, বিমা তথ্য বিশ্লেষণ ইত্যাদি কার্যক্রমের জন্য পরামর্শক সেবা সংগ্রহ এবং সম্পদ (আইসিটি সরঞ্জামাদি, অফিস সরঞ্জামাদি, আসবাবপত্র) সংগ্রহ করা হবে।
এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. ইফনুসুর রহমান বলেন, বিমা খাতকে শক্তিশালী করতে, এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে এবং অধিক সংখ্যক মানুষকে বিমা সুবিধার আওতায় আনতেই এ ধরনের প্রকল্প নিয়েছে সরকার। আশা করছি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মানুষ উপকৃত হবেন।